মুক্তিযুদ্ধের শেষ ছয় মাস নিজের বাড়িতে যাকে আশ্রয় দিয়েছিলাম সেই ছদ্মবেশী মান্নান, যে আসলে ছিলো আলবদরদের অন্যতম সংগঠক মওলানা আব্দুল মান্নান (পরবর্তীতে দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক),সে-ই আমার স্বামী ডা.আলীমকে ৭১’এর ১৫ ডিসেম্বর আলবদরদের হাতে তুলে দিয়েছিল।
বিশিষ্ট চিকিৎসক শহীদ ডা. আলীম চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বাসসকে একথা বলেন।
তিনি জানান, ২৯/১ পুরানা পল্টনে তিনতলা ভাড়া বাড়িতে নীচের তলায় ডা. আলীমের ক্লিনিক, দোতলায় নিজেরা থাকতেন। আর তিন তালায় থাকতেন শ্যামলী নাসরিনের বাবা মা। ২৫ মার্চের পরেই ক্লিনিক বন্ধ করে দিয়ে সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের আলাপ আলোচনা, আহতদের সেবা শুশ্রষা এবং আশ্রয়ের কাজে ব্যবহার করা হতো নীচতলাটি। এভাবেই চলছিল। জুলাই’৭১ এর মাঝামাঝি পাশের বাড়ির পিডিপি’র মতিন সাহেব একজন লোককে নিয়ে আসলেন। ডা. আলীমের কাছে আশ্রয় চাইলেন। সেদিন শ্যামলী নাসরিন তাকে আশ্রয় দিতে আপত্তি জানালেও বাড়ির অন্য সবার অনুরোধে পরিবারসহ যাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন অনেক পরে তারা জানতে পেরেছিলেন আশ্রিত লোকটিই মওলানা আবদুল মান্নান। মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে ডা. আলীমের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলো।
১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে ৪ টা। আমি, আলিম আর আমার মা ঝুল বারান্দায় বসে ছিলাম। চারিদিকে মিত্রবাহিনীর বোমা আর কামানের গুলি। ওরা তখন পাক আর্মি আর রাজাকারদের ঘাঁটি গুলোতে আক্রমন করছিল। পরের দিন পাক বাহিনী আত্মসমর্পন করবে। সারাদেশ অপেক্ষায়। এমন সময় হঠাৎ দেখি কাদা লেপা একটি মাইক্রোবাস এসে দাঁড়ালো। প্রথমে মাইক্রোবাস দেখে আমরা কিছু মনে করিনি। কারণ এরকম মাইক্রোবাস প্রায়ই আসতো। কিন্তু সেদিন দেখলাম বন্দুক হাতে বেশ কয়েকজন লোক নামলো। তারও প্রায় ৩৫ মিনিট পরে ওরা আামদের দরজায় নক করলো। আমি আলীমকে বললাম, ওরা আমাদের দরজায় নক করছে। তখন আলীমের মুখটা কালো হয়ে গেলো”, বললেন শ্যামলী নাসরীন।
তিনি বলেন, পেছন দিয়ে বেরুনোর একটা সিঁড়ি ছিলো। মুক্তিযোদ্ধারা এলে পালিয়ে আমাদের বাসায় যাতে আসতে পারে, তার জন্য সবসময় দরজাটা খোলা রাখা হতো। সেই সিঁড়ি দিয়ে যখন আমি মান্নানকে ডাকলাম, বললাম, ওরাতো আসছে। আপনি আসেন। তখন মান্নান বলেছিল, আপনি যান। আমি আছি। কোন ভয় নেই। পরে সেই দরজা দিয়েই আলীম নীচে নামার চেষ্টা করলেন। কিন্তু মান্নান সেদিন ভেতর থেকে নীচের দরজা বন্ধ করে চুপ করে নিজের ঘরে বসে ছিলো। সেই লোকগুলো আলীমকে নিয়ে গেলো।
বেদনা বিষন্ন স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে মিসেস চৌধুরী বলেন, সারারাত জেগে বসে রইলাম। ভোরের আকাশে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি শুনে এক বুক আশা নিয়ে দরজায় দাঁড়ালাম। এখনতো দেশ স্বাধীন হয়েছে, এখন নিশ্চয় মানুষটি ফিরে আসবে। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে খুঁজে নিয়ে আসবে।
কিন্তু সেই ‘জয়বাংলা‘ ধ্বনি থামিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা যখন জানতে চাইলেন, ভাবী রাজাকার মান্নান কোথায়, যে আলীম ভাইকে হত্যা করেছে, তাকে আমরা এখনই শেষ করে দেবো ! বিজয়ের আনন্দে যখন সারা দেশ উল্লসিত তখনই নাসরিন জানলেন, তাঁর সবচেয়ে কাছের প্রিয় মানুষটি আর পৃথিবীতে নাই! তাঁর সরলতা, মানবিকতা আর উদারতার সুযোগ নিয়ে মান্নান তাকে হত্যা করেছে। আলবদরদের হাতে তুলে দিয়েছে।
তিনি জানান, মুক্তিযোদ্ধাদের আসার খবর পেয়ে সুচতুর আব্দুল মান্নান ভীড়ের মধ্যে কখন পালিয়ে গেছে, তাকে কেউ ধরতে পারেনি ? এর পরেও দু’দুবার মুক্তিযোদ্ধারা মান্নানকে ধরে নিয়ে এলেও সুচতুর কৌশলে প্রাণে বাঁচতে সক্ষম হয় সে।
আর মুক্তিযুদ্ধের নয়মাসে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা দিয়ে, আশ্রয় দিয়ে সেবা দিয়েছেন, সারা জীবন দেশের জন্য আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন, দেশের জন্য কাজ করেছেন সেই ডাক্তার আলীমের লাশ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল ১৮ ডিসেম্বর রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে। ডা: ফজলে রাব্বির পাশে তাঁকেও দুচোখ বেধে, হাত বেঁধে বেয়নেটের আঘাতে হত্যা করা হয়।
আমি কখোনই আমার স্মৃতি থেকে একটি ভাবনা সরাতে পারিনা! সেটা হলো, আলবদররা যখন ওঁর চোখ বাঁধছিলো, হাত বাঁধছিলো, বেয়োনেট দিয়ে খোঁচাচ্ছিল, তখন কি মনে হয়েছিল ওঁর ? কেমন লেগেছিল?
বেদনার বিমূঢ়তা আজো কাটিয়ে উঠতে পারেন নি নাসরিন। রায়ের বাজারের বধ্যভূমির সেই নৃশংসতা আজো এতো জীবন্ত হয়ে আছে তাঁর চোখে, যেন এখনো অনুভব করেন ডা. আলীমের শেষ মুহূর্তের কষ্টের অনুভূতি। বাসস।