ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যায় দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে তার দুই সহপাঠী কামরুন নাহার মনি ও জাবেদ হোসেন।
শনিবার বিকেল ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম শরাফ উদ্দিন আহম্মেদের আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয় তারা।
পরে মামলার তদন্ত সংস্থা পিবিআইয়ের চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ পুলিশ সুপার মো. ইকবাল বলেন, কামরুন নাহার মনি ও জাবেদ হোসেন হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত—আর এ ঘটনার সময় বোরকা পরা পাঁচ জনের মধ্যে তারা দুজন।
নুসরাতকে হাত-পা বাঁধার পর মনি ছাদে শুইয়ে গলা চেপে ধরে। আসামি জাবেদ সে সময় নুসরাতের গায়ে এক লিটার কেরোসিন ঢেলে দেয়ার পর ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় বলে জানান তিনি।
গত ৬ এপ্রিল সকালে নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়া হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চার দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে হার মানেন তিনি। আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাতকে পরীক্ষার হল থেকে ছাদে ডেকে নিয়ে এই ঘটনা ঘটানো হয়।
সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ করায় এ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তিনি।
এর আগে নুসরাতকে ছাদে ডেকে নেয়ার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে তার আরেক সহপাঠী উম্মে সুলতানা পপি সে অধ্যক্ষ ধর্ষক সিরাজের ভাগ্নি। পরদিন তার আরও দুই সহপাঠী এই হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে।
নুসরাত হত্যার দায় স্বীকার করে এ পর্যন্ত আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে সাত জন।
তারা হলো: নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, আবদুর রহিম শরিফ ও হাফেজ আবদুল কাদের।
এই হত্যাকাণ্ডে দোষ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেওয়া ওই মাদ্রাসার ছাত্র শাহাদাত হোসেন শামীমের আত্মীয় কামরুন নাহার মনিই বোরকা কিনে ঘটনার দিন সকালে শামীমের হাতে দেয়।
নুসরাত হত্যা: খাল থেকে বোরকা উদ্ধার
নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার সময় ব্যবহৃত বোরকাগুলো যে দোকান থেকে কেনা হয়েছিল শুক্রবার দুপুরে মনিকে নিয়ে সোনাগাজী পৌরশহরের মানিক মিয়া প্লাজার সেই দোকানে অভিযান চালায় পিবিআই।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ফেনীর পিবিআই পরিদর্শক মো. শাহ আলম জানান, শনিবার সোনাগাজী সরকারি কলেজের পেছনের একটি খাল থেকে ওই তিনটি বোরকার একটি উদ্ধার করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার তাদের আরেক সহপাঠী যোবায়েরের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বোরকাগুলো পাওয়া যায়।
জাবেদ হোসেন মাদ্রাসায় লেখাপড়ার পাশাপাশি সোনাগাজীর পৌর কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা মাকসুদ আলমের সহকারী হিসেবে কাজ করে। মাকসুদও এ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে এখন রিমান্ডে আছে।
সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিনকেও এ হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শনিবার বিকেলে তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে ফেনীর একটি আদালত।
এদিকে, নুসরাত হত্যায় জড়িত অভিযোগে শনিবার রাঙামাটি ও কুমিল্লা থেকে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তারা হলো- ইফতেখার উদ্দিন রানা (২১) ও মো. এমরান হোসেন মামুন (২২)। এ দুজনও ওই মাদ্রাসায় নুসরাতের সঙ্গে পড়ত।
দুজনেরই বাড়ি সোনাগাজীর চরগনেশ এলাকায়। ওই গ্রামের জামাল উদ্দিনের ছেলে রানা আর মামুনের বাবার নাম এনামুল হক।
তদন্তকারীদের দাবি, ইফতেখার উদ্দিন রানা নামের এ যুবক নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার পরিকল্পনাকারীদের একজন।
পিবিআইয়ের চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মঈনউদ্দিন বলেন, শনিবার ভোরে রাঙামাটি সদরের টিঅ্যান্ডটি আবাসিক এলাকার একটি বাসা থেকে রানাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
বিশেষ পুলিশ সুপার ইকবাল বলেন, কুমিল্লার পদুয়ারবাজার থেকে শনিবারই মামুনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পিবিআই কর্মকর্তারা জানান, নুসরাতের ভাই যে মামলা করেছেন সেখানে ইফতেখার উদ্দিন রানা ও এমরান হোসেন মামুনের নাম ছিলনা তবে তদন্তে তাদের সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া গেছে।
কারাগারে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার সঙ্গে দেখা করে আসার পর তার অনুসারীরা মাদ্রাসার হোস্টেলে যে বৈঠকে বসে নুসরাতকে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করেন, সেই বৈঠকে ছিল রানা ও মামুন।
এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে এখন পর্যন্ত ২১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তারা হলো- মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ-উদ-দৌলা, সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন, পৌর কাউন্সিলর ও পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম, শিক্ষক আবছার উদ্দিন, সহপাঠী আরিফুল ইসলাম, নূর হোসেন, কেফায়াত উল্যাহ জনি, মোহাম্মদ আলা উদ্দিন, শাহিদুল ইসলাম, অধ্যক্ষের ভাগ্নি উম্মে সুলতানা পপি, জাবেদ হোসেন, যোবায়ের হোসেন, নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন, মো. শামীম, কামরুন নাহার মনি, আবদুর রহিম শরিফ, হাফেজ আবদুল কাদের, ইফতেখার হোসেন রানা ও এমরান হোসেন মামুন।
মামলার এজহারভুক্ত আট জনের সবাই গ্রেপ্তারদের মধ্যে আছে।
প্রসঙ্গত, নুসরাত জাহান রাফি সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার আলিমের পরীক্ষার্থী ছিলেন। ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে ওই ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ওঠে। নুসরাতের মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে ২৭ মার্চ সোনাগাজী থানায় মামলা দায়ের করেন। এরপর তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মামলা তুলে নিতে বিভিন্নভাবে নুসরাতের পরিবারকে হুমকি দেয়া হয়। ৬ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে আলিম পর্যায়ের আরবি প্রথমপত্রের পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে যান নুসরাত। এসময় তাকে কৌশলে একটি বহুতল ভবনে ডেকে নিয়ে যায় অধ্যক্ষের ভাগ্নি পপি। সেখানে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয়া হয়। ১০ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যান নুসরাত।