ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসা শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফির গায়ে আগুন দিয়েছিল চার জন। এরমধ্যে একজনের নাম শাহাদাত হোসেন শামীম। আরেকটি মেয়ে ছিল।
আগুন দিয়ে মাদ্রাসার মূল গেট দিয়েই পালিয়ে যায় তারা ব্রিফিংয়ে এসব কথা জানান পিবিআইয়ের ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার।
শনিবার সকালে রাজধানীর ধানমন্ডিতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) হেড কোয়ার্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান তিনি।
তিনি বলেন, আলোচনা করে নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার পরিকল্পনা করে আসামিরা, এরমধ্যে মাদ্রাসা অধ্যক্ষের কু-কীর্তির প্রতিবাদ, শাহাদাতের প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় তার গায়ে আগুন দেয়া হয়। এ সময় ৪ জন উপস্থিত ছিল এ ঘটনায় জড়িত আছে ১৩ জন আর ৭ জনকে ধরা হয়েছে বলে জানান তিনি।
এ হত্যাকাণ্ড মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার নির্দেশে ঘটেছে বলে জানান পিবিআইয়ের ডিআইজি।
নুসরাত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আসামি নুর উদ্দিনকে গ্রেপ্তারসহ মামলার তদন্ত কাজে বেশ অগ্রগতি হয়েছে বলে জানান তিনি।
অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার নির্দেশে কারা নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করে, আগুন ধরিয়ে দেয়ার কাজে সরাসরি কারা অংশ নেয় সব তথ্যই তুলে ধরেন পিবিআই কর্মকর্তা।
এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৩ জনের সংশ্লিষ্টতার কথা জানান বনজ কুমার মজুমদার। নারীর পাশাপাশি শাহাদাত হোসেন শামীম বোরখা পরে রাফির গায়ে আগুন দেয় বলেও পুলিশের বক্তব্য উঠে আসে।
এদিকে, শাহাদাতকে বৃহস্পতিবার রাতে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর আগে পিবিআইয়ের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া নুর উদ্দিন ঘটনায় সময় মাদ্রাসার গেটেই অবস্থান করছিলো বলে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে।
নুসরাত হত্যার বিচারের দাবিতে শনিবার রাজধানীর গণভবন এলাকা থেকে বঙ্গভবন পর্যন্ত মানববন্ধন পালন করেছেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ।
সকাল ১১টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত এ কর্মসূচি পালিত হয়।
সকালে মানববন্ধনে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও বাম ছাত্র সংগঠন, ছাত্রলীগ, সাংস্কৃতিক সংগঠন, নারী অধিকার সংগঠন এবং বিভিন্ন এনজিওর উদ্যোগে এ কর্মসূচি পালন করা হয়।
মানববন্ধনটি রাজধানীর আসাদগেট, কলাবাগান, সায়েন্স ল্যাবরেটরি,এলিফেন্ট রোড, বাটা সিগন্যাল, কাঁটাবন, শাহাবাগ, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট, হাইকোর্ট, প্রেসক্লাব, পল্টন মোড়, দৈনিক বাংলা মোড়, রাজউক ভবন এলাকায় অনুষ্ঠিত হয়।
মানববন্ধনে আসাদগেট এলাকায় উপস্থিত আছে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) কাফরুল থানা, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন কাফরুল থানা, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন মোহাম্মদপুর-আদাবর থানা, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পগোষ্ঠী মোহাম্মদপুর শাখা, ঘাসফড়িং খেলাঘর আসর, ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড আর্কিটেক্টস ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, আনন্দদ্যুতি খেলাঘর আসর।
এসময় আনন্দদ্যুতি খেলাঘর আসরের সভাপতি লাবনী শবনম মুক্তি তার বক্তব্যে বলেন, নুসরাতের মুখে আমার মেয়ের মুখ দেখতে পাই। দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে আজ এমন পরিবেশ হয়েছে। আমরা নুসরাত হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবো।
কে এই নুসরাত জাহান রাফি:
সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী ছিল। এ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা তাকে যৌন নিপীড়ন করলে নুসরাতের মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী থানায় মামলা দায়ের করেন।
এরপর অধ্যক্ষকে আটক করে পুলিশ। মামলা তুলে নিতে বিভিন্ন ভাবে নুসরাতের পরিবারতে হুমকি দেয়া হয়। গত ৬ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে আলিম পর্যায়ের আরবি প্রথম পত্র পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে যায় নুসরাত। এরপর কৌশলে তাকে পাশের ভবনের ছাদে ডেকে নেয়া হয়। তাকে মামলা তুলে নেয়া কথা বলে ভয় দেখানো হয়। পরে সেখানে বোরকা পরিহিত ৪/৫ ব্যক্তি নুসরাতের শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে তার শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে যায়। পরে তাকে উদ্ধার করে তার স্বজনরা প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে ফেনী সদর হাসপাতালে পাঠান। সেখান প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়।
গত সোমবার দগ্ধ মাদ্রাসাছাত্রীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানোর নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে ঢামেকের চিকিৎসজানান, নাজুক শারীরিক অবস্থার কারণে তাকে সিঙ্গাপুরে নেওয়া সম্ভব না। শনিবার রাতে অবস্থার আরও অবনতি ঘটলে নুসরাত মারা যায়।
গতকাল সকালেও নুসরাত হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে দ্রুত বিচার করার পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত সংঘবদ্ধ চক্রের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান বিশিষ্টজনেরা।
রাজধানীর শাহবাগে নিপীড়ন ও ধর্ষণবিরোধী এক মানববন্ধনে এমন দাবি জানানো হয়।
সমাজে বিচারহীনতার অভাবেই নারীরা প্রতিনিয়ত যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে বলেও জানান বক্তারা।
নারী নিপীড়ন ও ধর্ষণ রোধে শুক্রবার সকালে রাজধানীর শাহবাগে মানববন্ধন ও পদযাত্রার আয়োজন করা হয়। মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করেন সমাজের সর্বস্তরের মানুষ।
গত বুধবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যান নুসরাত।
নুসরাতকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। তার শরীরের ৮৫ শতাংশ আগুনে পুড়ে যাওয়ায় তাকে আর বাঁচানো যায়নি বলে জানান বার্ন ইউনিটের চিকিৎসরা।